হেপাটাইটিস কি কারনে হয় ?

 পৃথিবীতে যে কত রকমের রোগ আছে তার সবগুলোর নাম আমরা জানি না । আবার মাঝে মাঝে নতুন রোগের নামও শোনা যায় । আমরা যে রোগ গুলোর নাম জানি তার মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস বা হেপাটাইটিস একটি । এই রোগে মানুষের মৃত্যুর রেকর্ডও আছে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০১৩ সালের কথা । সে সময় প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় ।



Hepatitis




আপনার কি ভাইরাল হেপাটাইটিস আছে ? যদি থাকে তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য । আর যদি না থাকে তাহলেও আপনার জন্য । কেননা সাবধানের মার নেই । কখন কোন রোগ আপনার উপর চেপে বসবে তা কিন্তু জানা মুশকিল । তবে সতর্ক থাকলে অনেকটা এড়ানো যায় । তো এবার আসুন বিস্তারিত জেনে নেই । 



ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে জানার আগে জানব ভাইরাস কি ? এতে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে । 


ভাইরাস কি ? 

ভাইরাস হল কোন রোগ সৃষ্টিকারী বস্তু । আজ এমন এক ভাইরাস নিয়ে আলোচনা করব যা সাধারণ কথায় লিভার প্রদাহকে বুঝানো হয় । আসুন শুরু করি ।


ভাইরাল হেপাটাইটিস কি ? 



ভাইরাল হেপাটাইটিস হল একটি যকৃতের প্রদাহজনিত রোগ যা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। সাধারণত পাঁচটি প্রধান ভাইরাসের কারণে এটি হয়: হেপাটাইটিস A, B, C, D, এবং E। এই ভাইরাসগুলোর প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ছড়ায় এবং যকৃতের ওপর ভিন্ন মাত্রার প্রভাব ফেলে।



ভাইরাল হেপাটাইটিস কত প্রকার ও‌ কি কি ? 


আগেই বলেছি সাধারণত পাঁচটি প্রধান ভাইরাসের কারণে এটি হয়: হেপাটাইটিস A, B, C, D, এবং E । অর্থাৎ ভাইরাল হেপাটাইটিস এর প্রকার এই পাঁচ প্রকার । প্রতি প্রকারের বিস্তারিত বিবরণ নিচে তুলে ধরছি । 


হেপাটাইটিস A: সংক্রমিত খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সাধারণত স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয় এবং সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে না।


হেপাটাইটিস B: রক্ত, শরীরের তরল বা যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং যকৃতের ক্ষতি করতে পারে।


হেপাটাইটিস C: সাধারণত দূষিত সূঁচের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ সৃষ্টি করে এবং যকৃতের সেরোসিস বা ক্যান্সার হতে পারে।


হেপাটাইটিস D: শুধুমাত্র হেপাটাইটিস B সংক্রমিত ব্যক্তিদের হয়, কারণ এটি হেপাটাইটিস B ভাইরাসের উপর নির্ভরশীল।


হেপাটাইটিস E: দূষিত পানীয় বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সাধারণত স্বল্পমেয়াদী হয়, তবে গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি গুরুতর হতে পারে।



রোগের লক্ষণগুলো কি কি ? 



ভাইরাল হেপাটাইটিসের লক্ষণগুলো সংক্রমণের ধরন এবং রোগের অগ্রগতির উপর নির্ভর করে। অনেক সময় লক্ষণগুলো হালকা হতে পারে, বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে প্রধান লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:


ক্লান্তি (Fatigue): অতিরিক্ত দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব হওয়া।


জ্বর (Fever): হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় জ্বর হতে পারে।


বমি বমি ভাব ও বমি (Nausea and Vomiting): খাওয়ার পরে বা না খাওয়ার পরেও বমি বা বমি বমি ভাব হতে পারে।


পেটে ব্যথা (Abdominal Pain): বিশেষ করে ডান দিকের উপরের পেটে ব্যথা অনুভূত হয়, যেখান থেকে যকৃত অবস্থিত।


অরুচি (Loss of Appetite): খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া বা সম্পূর্ণ অরুচি দেখা দেয়।


পেশীতে বা গাঁটে ব্যথা (Muscle and Joint Pain): শরীরে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা।


গা হলুদ হওয়া (জন্ডিস) (Jaundice): চামড়া, চোখের সাদা অংশ হলদেটে হয়ে যাওয়া। এটি যকৃতের সমস্যা নির্দেশ করে।


গাঢ় প্রস্রাব (Dark Urine): প্রস্রাবের রং গাঢ় হলুদ বা বাদামী হওয়া।




এই লক্ষণগুলির উপস্থিতি এবং তাদের তীব্রতা ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। বিশেষত হেপাটাইটিস B এবং C দীর্ঘস্থায়ী আকার ধারণ করলে লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকট হয়, যা যকৃতের ক্ষতির দিকে ধাবিত করে।


ভাইরাল হেপাটাইটিস এর কারণ গুলো কি কি ? 

ভাইরাল হেপাটাইটিস এর কারণ গুলো এর আগে "ভাইরাল হেপাটাইটিস কত প্রকার ও‌ কি কি ? " - এই প্যারায় উল্লেখ করেছি । তথাপি আমি আবার নিচে বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি । 


ভাইরাল হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ধরন বিভিন্ন কারণে সংক্রমিত হয়। প্রতিটি ধরন ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ছড়ায় এবং সংক্রমণ সৃষ্টি করে। প্রধান কারণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:


১. হেপাটাইটিস A (Hepatitis A):

দূষিত খাবার বা পানীয় গ্রহণের মাধ্যমে ছড়ায়।

সংক্রামিত ব্যক্তির মলের মাধ্যমে ভাইরাসটি পরিবেশে আসে এবং অপরিচ্ছন্ন হাতে বা খাবার/পানীয়ে মিশে যায়।

সাধারণত অনুন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অঞ্চলে বেশি দেখা যায়, যেখানে পরিষ্কার পানি ও খাবারের সুরক্ষা নিশ্চিত নয়।

২. হেপাটাইটিস B (Hepatitis B):

সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত, বীর্য, বা শরীরের অন্যান্য তরলের মাধ্যমে ছড়ায়।

যৌন সংস্পর্শ, সংক্রমিত সূঁচ ব্যবহার (যেমন: মাদকাসক্তদের মধ্যে সূঁচ ভাগাভাগি), বা সংক্রমিত রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় সংক্রমিত মায়ের কাছ থেকে নবজাতকের দেহে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

৩. হেপাটাইটিস C (Hepatitis C):

সংক্রমিত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়।

সাধারণত দূষিত সূঁচ ব্যবহার (যেমন মাদকাসক্তদের মধ্যে) এর মাধ্যমে ছড়ায়।

কদাচিৎ যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে বা জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে শিশুর শরীরে ছড়াতে পারে।

৪. হেপাটাইটিস D (Hepatitis D):

এটি হেপাটাইটিস B এর সঙ্গে যুক্ত ভাইরাস। শুধুমাত্র হেপাটাইটিস B সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যেই এটি দেখা যায়।

সংক্রমিত রক্ত বা শরীরের তরল এর মাধ্যমে ছড়ায়।

৫. হেপাটাইটিস E (Hepatitis E):

দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়, যা সাধারণত স্বল্পমেয়াদী সংক্রমণ সৃষ্টি করে।

সাধারণত এমন অঞ্চলে বেশি দেখা যায় যেখানে পানির মান ভালো নয় এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত নয়।

অন্যান্য কারণ:

অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন: অপরিচ্ছন্ন খাবার ও পানির মাধ্যমে।

মাদকাসক্তি: নেশার জন্য ব্যবহৃত সূঁচ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করলে।

রক্ত বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন: সংক্রমিত রক্ত বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে।

যৌন সংস্পর্শ: সুরক্ষিত যৌনাচার না মানলে সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে।

এই কারণগুলোর মধ্যে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হেপাটাইটিস সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।




নিয়ন্ত্রণের উপায় কি ? 



ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক এবং চিকিৎসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এর মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা এবং সংক্রমণের পর তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। হেপাটাইটিসের ধরন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো কিছুটা ভিন্ন হলেও, সাধারণভাবে কিছু প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি রয়েছে যা সব ধরনের হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে কার্যকর।


প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:

১. টিকা (Vaccination):

হেপাটাইটিস A এবং B-এর টিকা পাওয়া যায়, যা সংক্রমণ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।

শিশুদের এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

হেপাটাইটিস B-এর টিকা সাধারণত জন্মের পরপরই শিশুদের দেওয়া হয়।

২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:

হাত ধোয়ার অভ্যাস: খাবার খাওয়ার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর ভালোভাবে হাত ধোয়া ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে সাহায্য করে, বিশেষত হেপাটাইটিস A এবং E-এর ক্ষেত্রে।

পরিচ্ছন্ন পানি ও খাবার ব্যবহার: দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস A এবং E ছড়ায়। তাই নিরাপদ পানি ও সঠিকভাবে রান্না করা খাবার গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

৩. সুরক্ষিত যৌন আচরণ:

যৌন সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা: হেপাটাইটিস B এবং C যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক (যেমন: কনডম ব্যবহার) বজায় রাখা জরুরি।

৪. রক্ত এবং শরীরের তরল থেকে সুরক্ষা:

নিষ্কলুষ সূঁচ ব্যবহার: সংক্রমিত সূঁচ ব্যবহারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস B এবং C ছড়াতে পারে। মাদকাসক্তদের মধ্যে সূঁচ ভাগাভাগি করা বিপজ্জনক।

রক্ত গ্রহণের আগে পরীক্ষা করা: রক্ত গ্রহণ করার সময় সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে রক্ত পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫.ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা: দাঁতের ব্রাশ, নখের কাঁচি, বা শেভিং রেজার অন্যের সাথে ভাগাভাগি না করা উচিৎ, কারণ এগুলো হেপাটাইটিস B এবং C ছড়াতে পারে।

৬. যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি:

উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব হলে সেই অনুযায়ী পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করা এবং চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করা।


চিকিৎসামূলক ব্যবস্থা:

১. প্রাথমিক চিকিৎসা ও সঠিক পুষ্টি:

হেপাটাইটিসের সংক্রমণ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্রাম, সঠিক পুষ্টি, এবং প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করা জরুরি।

অ্যালকোহল, তেল ও চর্বিজাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকা দরকার, কারণ এটি যকৃতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

২. অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ:

হেপাটাইটিস B এবং C-এর চিকিৎসায় অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয়, যা ভাইরাসের বিস্তার কমাতে এবং যকৃতের ক্ষতি প্রতিরোধে সহায়ক।

হেপাটাইটিস C-এর ক্ষেত্রে opiate agonist therapy (OAT) কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত । 

৩. রোগ পর্যবেক্ষণ:

দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস সংক্রমণের ক্ষেত্রে যকৃতের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও যকৃতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রোগের উন্নতি বা অবনতি নির্ধারণ করা হয়।

৪. যকৃত প্রতিস্থাপন:

যাদের যকৃতের সমস্যা অর্থাৎ লিভার ফেইলিউর হয় তাদের লিভার বা যকৃতের প্রতিস্থাপন করা জরুরি । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম