জলবসন্ত হলে করণীয় কী ?

 গ্রীষ্মকালীন যে সমস্ত রোগের প্রাদুর্ভাব থাকে তার মধ্যে জলবসন্ত একটি ‌ । যদিও এখন গ্রীষ্মের শেষ সময় । শীতের আমেজ কিছুটা দেখা যাচ্ছে । তারপরও যেহেতু গ্রীষ্মকালীন শেষ সময় তথাপি জলবসন্ত নিয়ে লিখছি ‌ । আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হল জলবসন্ত সংক্রান্ত ‌ । 




Chicken pox




জলবসন্ত কি ? 






জলবসন্ত, যা চিকেনপক্স (Chickenpox) নামে পরিচিত, একটি সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ যা ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস (Varicella-Zoster Virus) দ্বারা হয়। এটি সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে বড়দেরও হতে পারে। এই রোগটি শীতের শেষে বসন্তের আগমনে প্রাদুর্ভাব ঘটে । রোগটি ততটা মারাত্মক নয় । তবে মনে রাখতে হবে জলবসন্ত কিন্তু ছোঁয়াচে রোগ । 






জলবসন্তের লক্ষণ গুলো কি কি ? 




জলবসন্তের (চিকেনপক্স) প্রধান লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:




ফুস্কুড়ি বা ফোসকা: ত্বকে ছোট ছোট লাল দাগ বা ফোসকা দেখা যায়, যা পরে ফেটে যায় এবং তার মধ্যে তরল পদার্থ থাকে। এগুলো মুখ, বুক, পিঠ এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।




জ্বর: সাধারণত ১০০-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর হয়।




মাথাব্যথা: হালকা থেকে মাঝারি ধরনের মাথাব্যথা হতে পারে।




শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতা: ক্লান্তি, শরীরের ব্যথা এবং দুর্বলতার অনুভূতি হয়।




ক্ষুধামন্দা: খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে।




চুলকানি: ফোস্কাগুলোতে প্রচণ্ড চুলকানি হয়, যা ফোসকা ফেটে যাওয়ার পরেও অব্যাহত থাকে।




কাশি : কিছু ক্ষেত্রে কাশি দেখা যেতে পারে ।‌




লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ১০ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়, এবং রোগী সংক্রামিত হওয়ার ২-৩ দিন আগে থেকে সংক্রামক হয়ে ওঠে।




জলবসন্ত রোগ হওয়ার কারণ গুলো কি কি ? 




জলবসন্তের (চিকেনপক্স) প্রধান কারণ হলো ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস (Varicella-Zoster Virus)। এটি একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং রোগ সৃষ্টি করে। জলবসন্ত ছড়ানোর প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ:




সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা: জলবসন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির ফোস্কা বা ফুস্কুড়ির তরল বা সরাসরি সংস্পর্শে এলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।




হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে: আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাস বায়ুবাহিত হওয়ার ফলে সহজেই এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ ঘটে।




সংক্রমণ হওয়ার আগে সংস্পর্শ: রোগী সংক্রমিত হওয়ার ১-২ দিন আগেও ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম থাকে, তাই অনেক সময় সংক্রমণ ধরা পড়ার আগেই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।




আক্রান্ত জিনিসপত্র স্পর্শ করা: আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, বিছানার চাদর বা অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র স্পর্শ করার মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।




যারা আগে জলবসন্তে আক্রান্ত হননি বা ভ্যাকসিন নেননি, তাদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।






জলবসন্ত কি বাহিত রোগ ? 




হ্যাঁ, জলবসন্ত (চিকেনপক্স) একটি বাহিত রোগ। এটি ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ, যা মূলত বায়ুবাহিত (Airborne) এবং সংক্রামিত ব্যক্তির শরীরের তরল বা ফোস্কা থেকে ছড়ায়।






জলবসন্ত কত দিন থাকে ? 




জলবসন্ত সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়কালের মধ্যে রোগের বিভিন্ন ধাপ দেখা যায়:




প্রাথমিক লক্ষণ: সংক্রমণের ১-২ দিন আগে থেকে জ্বর, মাথাব্যথা, ক্লান্তি এবং দুর্বলতা দেখা দেয়।




ফুস্কুড়ি দেখা দেওয়া: প্রথম ২-৩ দিনের মধ্যে শরীরে ফোস্কা বা ফুসকুড়ি ওঠে, যা তরল ভরা থাকে। এগুলো মুখ, বুক, পিঠ এবং পরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।




ফোস্কা শুকানো: ৫-৭ দিনের মধ্যে ফোস্কাগুলো শুকিয়ে যায় এবং সেগুলো খোসা হয়ে পড়তে শুরু করে।




সুস্থ হওয়া: ৭-১০ দিনের মধ্যে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং ফোস্কার খোসা পড়ে নতুন ত্বক গজাতে শুরু করে।




তবে, কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি রোগী শিশু, বয়স্ক বা যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, তাদের ক্ষেত্রে সুস্থ হতে একটু বেশি সময় লাগতে পারে।








চিকিৎসা কি ? 




জলবসন্তের (চিকেনপক্স) জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, কারণ এটি সাধারণত নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে, লক্ষণগুলো উপশম করতে এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। রোগীর অসুস্থতার মাত্রার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসার ধরন নির্ধারণ করা হয়। নিচে জলবসন্তের জন্য সাধারণত ব্যবহৃত চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:




১. এন্টিভাইরাল ওষুধ:


অ্যাসাইক্লোভির (Acyclovir) মতো এন্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা ভাইরাসের বৃদ্ধি কমাতে সাহায্য করে। এটি রোগের গুরুতরতা কমাতে পারে, তবে শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধটি গ্রহণ করা উচিত। সাধারণত রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সবচেয়ে কার্যকর।


২. জ্বর ও ব্যথা উপশমের ওষুধ:


প্যারাসিটামল (Paracetamol): জ্বর ও ব্যথা উপশমে ব্যবহার করা হয়। অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এটি জলবসন্তের ক্ষেত্রে রাইস সিনড্রোম (Reye's Syndrome) নামক একটি গুরুতর জটিলতা তৈরি করতে পারে।


৩. চুলকানি ও ফোসকার চিকিৎসা:


ক্যালামাইন লোশন: চুলকানি উপশমে কার্যকর। এটি ত্বকে ব্যবহার করলে ফোস্কার কারণে হওয়া চুলকানি ও অস্বস্তি কমায়।


ওটমিল বাথ: হালকা উষ্ণ পানিতে ওটমিল মিশিয়ে গোসল করলে ত্বকের চুলকানি ও অস্বস্তি কমে।


এন্টিহিস্টামিন: যদি চুলকানি খুব বেশি হয়, তবে চিকিৎসক এন্টিহিস্টামিন ওষুধ দিতে পারেন, যা চুলকানি কমাতে সাহায্য করে।


৪. পানি ও পুষ্টি:


রোগীকে প্রচুর পানি এবং তরল খাবার খেতে উৎসাহিত করা হয়, যাতে শরীর ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা পায়।


পুষ্টিকর খাবার খাওয়া রোগীর দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়ক।


৫. ফোসকা না খোঁচানো:


ফোসকাগুলো না খোঁচানোর পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে এবং দাগ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


৬. বাড়তি যত্ন:


আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রামে থাকতে বলা হয়।


রোগীকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখতে হয়, যাতে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে।


৭. গুরুতর ক্ষেত্রে:


যদি রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে বা রোগটি গুরুতর হয় (যেমন গর্ভবতী নারী, নবজাতক, বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে), তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।


৮. ভ্যাকসিন:


যদি কারও জলবসন্ত না হয় এবং আগে ভ্যাকসিন না নিয়ে থাকে, তাহলে তাকে প্রতিরোধমূলক ভ্যারিসেলা ভ্যাকসিন দেওয়া যেতে পারে। সংক্রমণের আগে বা সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্যাকসিন দেওয়া হলে রোগের গুরুতরতা কমতে পারে।


জলবসন্ত সাধারণত নিজে থেকে সেরে যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করা উচিত।






জলবসন্তের টিকা কি ? 




জলবসন্তের (চিকেনপক্স) প্রতিরোধের জন্য যে টিকা দেওয়া হয়, সেটিকে ভ্যারিসেলা টিকা (Varicella Vaccine) বলা হয়। এই টিকা ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরকে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে।




ভ্যারিসেলা টিকা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:




কার্যকারিতা: ভ্যারিসেলা টিকা অত্যন্ত কার্যকর। এই টিকা দেওয়ার ফলে ৯০-৯৫% ক্ষেত্রে জলবসন্তের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। যারা টিকা নেওয়ার পরেও সংক্রমিত হন, তাদের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা কম থাকে।




টিকার ডোজ:




শিশুরা: সাধারণত শিশুদের দুইটি ডোজ দেওয়া হয়:


প্রথম ডোজ: ১২-১৫ মাস বয়সে।


দ্বিতীয় ডোজ: ৪-৬ বছর বয়সে।


প্রাপ্তবয়স্করা: যারা আগে টিকা নেননি বা জলবসন্তে আক্রান্ত হননি, তাদেরও দুইটি ডোজ নিতে হয়।


ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা: যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, গর্ভবতী নারী, ক্যান্সার রোগী, বা স্টেরয়েড ওষুধ গ্রহণকারীরা ভ্যারিসেলা টিকা নিতে পারেন না। এদের ক্ষেত্রে টিকা নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।




পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: টিকা নেওয়ার পর হালকা জ্বর, ইনজেকশন দেওয়ার স্থানে ব্যথা বা লালচেভাব, এবং কিছু ক্ষেত্রে হালকা ফুসকুড়ি দেখা যেতে পারে, যা স্বাভাবিক এবং সাময়িক।




ভ্যারিসেলা টিকা জলবসন্ত প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি এবং যারা টিকা নেন তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে।




জলবসন্ত রোগীর খাবার কি কি ? 




জলবসন্তের সময় রোগীর শরীরে অনেক দুর্বলতা আসে এবং ফোস্কার কারণে খাওয়া-দাওয়া কষ্টকর হতে পারে। সঠিক পুষ্টিকর খাবার রোগীকে দ্রুত সুস্থ হতে সহায়তা করে। জলবসন্ত রোগীর জন্য সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিছু প্রস্তাবিত খাবার হলো:




১. তরল এবং হালকা খাবার:


ডাবের পানি: শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করে এবং ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স বজায় রাখে।


সুপ বা ব্রথ: পুষ্টি দেয় এবং হালকা খাবার হিসেবে সহজে হজম হয়।


ফল এবং সবজির জুস: ভিটামিন এবং খনিজ সরবরাহ করে। বিশেষ করে কমলালেবুর মতো ভিটামিন C সমৃদ্ধ ফলের জুস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।


২. নরম খাবার:


ভাতের পায়েস, খিচুড়ি: সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর।


ওটমিল বা নরম দুধের পায়েস: হালকা এবং সহজে খাওয়া যায়।


সেমাই, সুজি: নরম ও হালকা খাবার হিসেবে উপযোগী।


৩. ফলমূল:


পাকা কলা: সহজপাচ্য এবং রোগীর শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।


আপেল, নাশপাতি: হালকা ফল হিসেবে উপকারী।


পেঁপে: হজমে সহায়ক এবং পুষ্টিকর।


৪. সিদ্ধ ও হালকা রান্না করা খাবার:


সিদ্ধ ডিম: প্রোটিনের ভালো উৎস এবং সহজে হজম হয়।


সবজির স্টু: শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করে।


৫. বেশি পানি:


প্রচুর পানি পান করা জরুরি। জলবসন্তের সময় শরীর ডিহাইড্রেট হয়ে যেতে পারে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, লেবুর শরবত, ডাবের পানি খাওয়া উচিত।


৬. দই:


দইয়ের প্রোবায়োটিক গুণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে এবং হজম শক্তি উন্নত করে।


এড়িয়ে চলার খাবার:


মসলাযুক্ত খাবার: মশলাদার খাবার ফোস্কা ও ত্বকের জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দিতে পারে।


তেলযুক্ত বা ভাজা খাবার: হজমে সমস্যা করতে পারে এবং শারীরিক দুর্বলতা বাড়িয়ে দেয়।


অ্যাসিডিক ফল: যেমন লেবু, কমলালেবু ইত্যাদি সরাসরি খাওয়া ফোস্কার কারণে মুখে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। তবে জুস আকারে খাওয়া যেতে পারে।


এই ধরনের খাবারগুলো রোগীর শরীরের জন্য হালকা এবং পুষ্টি সরবরাহ করে, যা দ্রুত সুস্থ হতে সহায়ক।




 যে সব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত । 






১. ফোসকা‌ বিলুপ্ত না পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে ‌যাওয়া নিষেধ 




২. কোন‌ মূল্যে ফোসকা ফাটানো যাবে না ।‌

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম