আমরা প্রতিনিয়ত প্রায়ই কিছু না কিছু রোগের কথা শুনে থাকি । তার কিছু শারীরিক আর কিছু মানসিক । আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো মৃগীরোগ । যে কোন রোগই শরীর ও মনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে । তাহলে প্রশ্ন দাড়ায় মৃগীরোগ কি রোগ ? শারীরিক না মানসিক ? আর এর পরিণতিই কি ?
যে সকল ব্যক্তির মাথায় সমস্যা আছে কিন্তু পাগল নয় এমন লোক কি কখন দেখেছেন ? এখন বলতে পারেন এটা কেমন কথা ? হ্যা ভাই মাথায় সমস্যা থাকা মানেই যে লোকটা পাগল তা তো নয় । আচ্ছা আমি এখানে বলতে চাচ্ছি যে এই আলোচিত রোগটার সাথে মাথার সম্পর্ক আছে । অর্থাৎ মৃগীরোগ একটা মানসিক রোগ । কোন শারীরিক রোগ নয় । তাহলে ,
মৃগীরোগ কি ?
এপিলেপসি বা মৃগীরোগ হলো একটি মস্তিষ্কের কারণে উৎপন্ন হওয়া অস্বাভাবিক ক্রিয়ার একটি রোগ।মানুষের মাইন্ডে অস্বাভাবিক ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি উৎপন্ন করতে পারে । অন্য ভাবে বললে মৃগী রোগ, যাকে ইংরেজিতে "Epilepsy" বলা হয়, একটি স্নায়বিক (নিউরোলজিক্যাল) অবস্থা যেখানে মস্তিষ্কে আকস্মিক এবং অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ঘটে, যার ফলে ব্যক্তির শরীরে খিঁচুনি বা "সিজার" হয়। এই রোগের কারণে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ কিছু সময়ের জন্য বাধাপ্রাপ্ত হয়, এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে অথবা অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। এপিলেপসির লক্ষণ গুলো বিভিন্ন রকমের হতে পারে যা নিয়ে পরেই আলোচনা করছি ।
এই ইলেকট্রিক্যাল অস্তিত্ব কারণে ব্যক্তি অস্বাভাবিক আচরণ, মাথা চুরানো, বা মানসিক অবস্থার পরিবর্তন অনুভব করতে পারে। এপিলেপসি বাচ্চাদের হয়তো জন্মের সময় থেকে থাকতে পারে বা প্রায়শই যৌবনের কোন সময়েই শুরু হতে পারে । আক্রান্ত ব্যক্তি খিঁচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । অর্থাৎ সে স্বাভাবিক কার্যক্রম হারায়।
চিকিৎসা না করালে মৃগী রোগ মারাত্মক হতে পারে, তবে সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়মিত ওষুধের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
মৃগীরোগের জন্য চিকিৎসা প্রদান করতে হলে অধিকাংশ মামলার জন্য প্রয়োজন হতে পারে মডার্ন এন্টি-এপিলেপটিক ঔষধগুলো, যার মাধ্যমে আকস্মিক মৃগীরোগের জন্য উপযোগী হতে পারে। তবে, এই রোগের পূর্ণ সমাধান হলো চিকিৎসা করানো ।
মৃগী রোগের লক্ষণগুলো কি কি ?
লক্ষণ: কোন লক্ষণ আছে কি ?
এপিলেপসির লক্ষণ গুলো বিভিন্ন হতে পারে, এবং এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্নতা দেখা যেতে পারে। মৃগী রোগের খিঁচুনি বা সিজার বিভিন্ন রকমের হতে পারে, এবং লক্ষণগুলোও সেগুলোর ধরন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। তবে, কিছু মূল লক্ষণ ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়:
আকস্মিক খিঁচুনি (Seizures): মৃগী রোগের সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ হলো খিঁচুনি। এই খিঁচুনির সময় রোগীর শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেঁপে ওঠে, হাত-পা মচকাতে থাকে, এবং সে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
শরীরের কোনো অংশ অনিয়ন্ত্রিতভাবে নড়া: কিছু ক্ষেত্রে শরীরের একটি অংশ, যেমন হাত, পা, বা মুখের পেশি, হঠাৎ করে কাঁপতে বা নড়তে শুরু করে।
মানসিক বা ভাবনামূলক পরিবর্তন: কিছু মানসিক বা ভাবনামূলক পরিবর্তন হতে পারে, যেমন অস্বাভাবিক ভাবনা, আতঙ্ক, বা ভীতি। অথবা বলা যেতে পারে যে চেতনা হারিয়ে গেছে বা সবকিছু গুলিয়ে ফেলে।
তাকানো: মৃগীরোগের অন্যতম একটি লক্ষণ হলো রোগী একদিকে কোন কারণ ছাড়াই তাকিয়ে থাকে । মানুষ যেমন অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সেটা বোঝার জন্য সেটার দিকে না বোঝা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে, ঠিক মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এরকমও নয় ।
অদ্ভুত অনুভূতি: কিছু রোগী খিঁচুনির আগে অদ্ভুত গন্ধ, স্বাদ, বা দৃশ্য অনুভব করতে পারে। একে "অরা" (Aura) বলা হয়।
ঝাঁকুনি: হাত ও পায়ে মারাত্মক রকমের ঝাঁকুনি হয় । খিঁচুনি বা ঝাঁকুনির সময় পায়খানা প্রস্রাব হতে পারে। এমনকি মুখ দিয়ে ফেনাও বের হতে পারে ।
মেমোরি বা স্মৃতির বিভ্রান্তি: খিঁচুনির পরে রোগী কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে এবং সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হতে পারে।
অজ্ঞান: রোগী হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে । জ্ঞান ফিরলে মনে করতে পারে না যে তার সাথে কি হয়েছিল। সে কথার উত্তর দিতে পারে না বা চারপাশের পরিস্থিতি বুঝতে পারে না।
মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন: খিঁচুনি শুরুর আগে বা পরে কিছু রোগী উদ্বেগ, ভয়, বা বিষণ্নতা অনুভব করতে পারে।
কামড়: মৃগীরোগ এর অন্যতম লক্ষণ হল জিহ্বা ও দাঁত কামড় লাগা ।
মাথা বা শরীরের অংশে দুঃস্থিতি: কিছু ব্যক্তিতে এপিলেপসির সময়ে মাথার দুঃস্থিতি দেখা যেতে পারে। এমনকি মেজাজ বদলে যেতে পারে। শরীর শক্ত হতে পারে ।
এপিলেপসি হওয়ার সময়ে এই লক্ষণগুলো দেখা হতে পারে যা শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ, তবে একজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা গুরুত্বপূর্ণ যেন সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা যায় । সঠিকভাবে চিকিৎসা না করালে এই রোগ আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
মৃগী রোগীর কারণ গুলো কি কি ?
এপিলেপসির কারণ বিভিন্ন হতে পারে, এবং তবে কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি। তবে, কিছু সাধারণ কারণ মনে রাখতে হবে:
জেনেটিক কারণ: মৃগী রোগের ক্ষেত্রে জেনেটিক বা বংশগত কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি পরিবারের কারো মৃগী থাকে, তবে অন্য সদস্যেরও এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মস্তিষ্কের বিকৃতি: মৃগী রোগ ক্যান্সার, টিউমার ইত্যাদির জন্য হতে পারে । এমনকি মাথায় আঘাত পেলেও হতে পারে । অর্থাৎ মাথায় গুরুতর আঘাত বা আঘাতজনিত ট্রমা মৃগী রোগের কারণ হতে পারে। এছাড়াও দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া, বা কোনো আঘাতের ফলে মস্তিষ্কে ক্ষতি হলে মৃগী হতে পারে।
মস্তিষ্কের গঠনগত অস্বাভাবিকতা: মস্তিষ্কের জন্মগত ত্রুটি বা গঠনগত অস্বাভাবিকতা, যেমন মস্তিষ্কের কোনো অংশ ঠিকমতো গঠিত না হলে, মৃগীর ঝুঁকি বাড়তে পারে।
মস্তিষ্কে টিউমার বা সংক্রমণ: মস্তিষ্কে টিউমার যার কথা আগেই বলেছি, মেনিনজাইটিস, এনসেফালাইটিসের মতো সংক্রমণ মৃগী রোগের কারণ হতে পারে।
স্ট্রোক: বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোক মৃগী রোগের অন্যতম সাধারণ কারণ। স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে সেই অংশের কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মৃগী হতে পারে।
ক্যালসিয়াম কম : এটা সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে হয় । সদ্যোজাত শিশুদের ক্ষেত্রে শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম থাকলে হতে পারে ।
প্রসবজনিত আঘাত: জন্মের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব বা অন্য কোনো আঘাতও শিশুদের মধ্যে মৃগী রোগের কারণ হতে পারে।
অ্যালকোহল বা মাদকদ্রব্যের ব্যবহার: অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মাদকদ্রব্যের ব্যবহার মস্তিষ্কের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে, যা মৃগী রোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই মৃগী রোগের নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায় না। একে "ইডিওপ্যাথিক মৃগী" বলা হয়, যেখানে রোগের কারণ অজানা থেকে যায়।
মৃগী রোগ থেকে বাঁচার উপায় কি ?
মৃগী রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। রোগের ধরন এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে চিকিৎসা এবং করণীয় বিষয়গুলো ভিন্ন হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ করণীয় তুলে ধরা হলো:
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ:
মৃগী রোগের চিকিৎসায় নিয়মিতভাবে ওষুধ সেবন গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার যে ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন, তা নিয়ম মেনে সময়মতো গ্রহণ করতে হবে। ওষুধ বন্ধ করা বা ডোজ পরিবর্তন করা উচিত নয়, কারণ এটি খিঁচুনির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
মডিকেশন অবলম্বন করুন: অনেক ক্ষেত্রে, ঔষধ দ্বারা এপিলেপসি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মোডিফাইড ওয়ানে মডিকেশন প্রবৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে।
নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন: আপনার সহযোগীদের এবং নিজের জন্য নিরাপদ একটি পরিবেশ তৈরি করুন এবং বিশেষভাবে এপিলেপসি হতে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিষয়টি এভাবে করলে হয় যে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ যেমন:
বাড়িতে বা কাজের জায়গায় এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে খিঁচুনির সময় আঘাতের ঝুঁকি কম থাকে।
সাঁতার বা উচ্চতায় ওঠা-নামার মতো কার্যকলাপের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
নিজেকে পরীক্ষা করুন: আপনি নিজেকে নিয়ে কোন প্রকার ব্যবস্থা নিতে পারেন এমন অসুস্থতা বোঝার জন্য নিজেকে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করুন। অর্থাৎ নিয়মিত চেকআপ এবং ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা পরিচালনা করা প্রয়োজন। ওষুধের কার্যকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়ানো:
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে, কারণ ঘুমের অভাব মৃগীর আক্রমণ বাড়াতে পারে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস এড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
অ্যালকোহল এবং মাদকদ্রব্য থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এগুলো খিঁচুনির ঝুঁকি বাড়ায়।
জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা:
খিঁচুনির সময় কী করতে হবে এবং কীভাবে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা পাওয়া যাবে তা পরিবার এবং বন্ধুদের জানানো উচিত।
খিঁচুনি ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে বা ধারাবাহিকভাবে ঘটলে জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন:
সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
ধূমপান, অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত।
সার্জারি বা অন্যান্য চিকিৎসা:
কিছু ক্ষেত্রে, যদি ওষুধে কাজ না করে, ডাক্তার সার্জারি, ভেগাস নার্ভ স্টিমুলেশন (VNS) বা কেটোজেনিক ডায়েটের মতো অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির পরামর্শ দিতে পারেন।
সমাজের সমর্থন:
মৃগী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে মানসিক এবং সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন। সমাজে সচেতনতা বাড়ানো এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নীত করা জরুরি।
মৃগী রোগের যথাযথ চিকিৎসা এবং সচেতনতা থাকলে রোগী সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে এবং খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।