মানবদেহের প্রয়োজনীয় যে অঙ্গ, উপাদান আছে ,সেই উপাদানের একটি হচ্ছে রক্ত । রক্ত ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না । দেখা যায় রক্ত কমে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত গ্রহণ করতে হয় । এখন বুঝুন কতটা মহামূল্যবান এই রক্ত। মুল্যবান হওয়া সত্ত্বেও কত সমস্যা যে হয় এই রক্তে । রক্তচাপ থেকে শুরু করে রক্ত দূষিত হওয়া, রক্ত কম হওয়া ইত্যাদি নানান সমস্যার কথা আমরা জানি । আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে রক্তচাপ নিয়ে ।
![]() |
| চিকিৎসক একজন রোগীর রক্তচাপ মাপছেন । |
রক্তচাপ (Blood Pressure) কি ?
রক্ত আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে।এই রক্ত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছায় একটি নির্দিষ্ট চাপের মাধ্যমে । যাকে বলা হয় রক্তচাপ। মানে এক কথায় যদি বলি রক্তপ্রবাহকালে ধমনির গায়ে সৃষ্ট চাপকে রক্তচাপ বলা হয় । এটি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের একটি । কিন্তু এই রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক সীমার বাইরে চলে যায়—অর্থাৎ বেশি বা কম হয়—তবে তা শরীরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
রক্তচাপ কত প্রকার ?
রক্তচাপ দুই প্রকার । যথা:
১. উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ হল ধমনীতে স্বাভাবিক এর চেয়ে রক্তের চাপ বেশী থাকা । পরবর্তী এ সম্পর্কে বিস্তারিত পাবেন ।
২.নিম্ন রক্তচাপ
নিম্ন রক্তচাপ হল ধমনীতে স্বাভাবিক এর চেয়ে রক্তের চাপ কম থাকা । এক্ষেত্রেও পরবর্তীতে লেখা আসবে ।
এখন কথা হচ্ছে মানুষের দেহে রক্তচাপ কেমন হলে মানব শরীর সুস্থ থাকে ? তার তো একটা সীমা থাকা উচিত তাই না ? যেটাকে বলা যায় আদর্শ রক্তচাপ ।
আদর্শ রক্তচাপ (Ideal blood pressure):
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষ যখন পরিণত বয়সে উপনীত হয় তখন তার আদর্শ রক্তচাপ (Blood pressure) সাধারণত 120/80 মিলিমিটার মানের কাছাকাছি। এই দুটি সংখ্যার মানে হল প্রথমটি উচ্চচাপ এবং দ্বিতীয়টি নিম্নচাপ।
এখানে বুঝার বিষয় হল রক্তের উচ্চ চাপের আদর্শ মান 120 মিলিমিটারের নিচে। আর নিম্নচাপের আদর্শ মান 80 মিলিমিটারের নিচে। তবে এটি বয়স, ওজন, মানসিক অবস্থা ও শারীরিক কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে।
রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের নাম কি ?
রক্তচাপ কীভাবে পরিমাপ করা হয় ?
রক্তচাপ সাধারণত মিলিমিটার অফ মার্কারি (mmHg) এককে মাপা হয়। দুটি মান থাকে—
সিস্টোলিক চাপ
হৃদপিণ্ড যখন রক্ত পাম্প করে, তখন ধমনিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়।
ডায়াস্টোলিক চাপ
হৃদপিণ্ড যখন বিশ্রাম নেয়, তখন ধমনিতে যে চাপ থাকে।
রক্তচাপ পরিমাপ করার জন্য স্ফিগোমোম্যানোমিটার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এটি হাতে একটি কাফ (cuff) পরিয়ে, স্ফীত করে এবং তারপর ধীরে ধীরে বাতাস বের করে ধমনীতে রক্তের প্রবাহের চাপ নির্ণয় করে। এতে দুটি মান পাওয়া যায় । যা সিস্টোলিক চাপ ও ডায়াস্টোলিক চাপ যা আগেই বলেছি ।
রক্তচাপ পরিমাপের সময় সাধারণ ভুলগুলো
রক্তচাপ মাপা একটি সহজ কাজ মনে হলেও ছোট ছোট ভুলের কারণে রিডিং অনেক সময় ভুল আসে। এই ভুলগুলো কমিয়ে দিলে আপনি আরও সঠিক রক্তচাপ পাবেন।
১. মাপার আগে বিশ্রাম না নেওয়া
অনেকেই দ্রুত বসে BP মাপেন। কিন্তু মাপার আগে অন্তত ৫ মিনিট চুপচাপ বসে বিশ্রাম না নিলে রিডিং সাধারণত বেশি আসে।
২. হাত সঠিকভাবে না রাখা
হাত যদি হৃদপিণ্ডের সমান উচ্চতায় না থাকে, রিডিং ৫–১০ mmHg পর্যন্ত ভুল হতে পারে।
হাত টেবিলের উপর রাখুন এবং শিথিল রাখুন।
৩. কাফ খুব ঢিলা বা খুব শক্ত করে বাঁধা
কাফ সঠিকভাবে না বাঁধলে রিডিং হঠাৎ কম বা বেশি দেখাতে পারে।
খুব ঢিলা থাকলে BP বেশি দেখায়।
খুব শক্ত হলে BP কম দেখায়।
৪. কথা বলা বা নড়াচড়া করা
BP মাপার সময় কথা বললে সিস্টোলিক এদিক সেদিক হতে পারে।
মাপার সময় একদম স্থির ও নীরব থাকুন।
৫. পুরো হাতের উপর কাপড় রেখে মাপা
শার্ট বা জামা গুটিয়ে তুললেও কখনো চাপ পড়ে থাকে, তাই হাত সম্পূর্ণ খালি রেখে মাপা সবচেয়ে ভালো।
৬. ধূমপান, কফি বা চা খাওয়ার পরপরই মাপা
এগুলো হৃদস্পন্দন বাড়ায়, ফলে রক্তচাপও সাময়িকভাবে বেড়ে যায়।
৩০ মিনিট আগে এ ধরনের কিছু না খাওয়াই ভালো।
৭. একবার মেপেই সিদ্ধান্ত নেওয়া
BP স্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। তাই দুইবার মাপুন ১ মিনিট বিরতি দিয়ে, এবং গড়টাই সত্যিকার রিডিং হিসেবে গণ্য করুন।
রক্তচাপের ভূমিকা
রক্তচাপের প্রধান ভূমিকা হলো শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টিগুণ পৌঁছে দেওয়া এবং একইসঙ্গে বর্জ্য পদার্থ অপসারণে সহায়তা করা।
এছাড়াও রক্তচাপ—
মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে, যাতে মনোযোগ, স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি ঠিক থাকে।
কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতা সচল রাখে।
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে।
রক্তচাপ ও মানসিক অবস্থার সম্পর্ক
অনেকেই জানেন না যে রক্তচাপের সঙ্গে আমাদের মানসিক অবস্থার গভীর সম্পর্ক আছে। যখন আমরা চাপ, ভয়, রাগ বা উদ্বেগে থাকি, তখন স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হয়ে হৃদপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দেয়। ফলে সাময়িকভাবে রক্তচাপের পরিবর্তন হতে পারে।
অন্যদিকে শান্ত, স্থির ও আনন্দময় মানসিক অবস্থা রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। তাই মনোভাব নিয়ন্ত্রণ রক্তচাপের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ব্যায়ামের আগে ও পরে রক্তচাপ কেমন থাকে
ব্যায়াম রক্তচাপের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এটি বোঝা রক্তচাপ পর্যবেক্ষণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যায়ামের আগে BP
ব্যায়াম শুরু করার আগে সাধারণত BP স্বাভাবিক মাত্রাতেই থাকে। তবে—
যদি আপনি ক্লান্ত,
কম ঘুমানো, অথবা
খালি পেটে থাকেন,
তাহলে BP কম বা বেশি উভয়ই হতে পারে।
ব্যায়ামের সময় BP
ব্যায়ামের সময়, বিশেষ করে দৌড়ানো বা ভার তুললে—
সিস্টোলিক রক্তচাপ বাড়ে
ডায়াস্টোলিক সাধারণত একই থাকে বা সামান্য কমে
এটা স্বাভাবিক, কারণ আপনার শরীর তখন অতিরিক্ত অক্সিজেন চায়।
ব্যায়ামের পর BP
ব্যায়াম শেষ করার পর শরীর রিলাক্স হতে থাকে, তখন—
সিস্টোলিক BP দ্রুত কমে আসে
অনেক সময় স্বাভাবিকের নিচেও নেমে যেতে পারে (Post-exercise hypotension)
এটা সাধারণত ৩০–৬০ মিনিট থাকে
ব্যায়াম BP-র জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
নিয়মিত ব্যায়াম—
হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে
রক্তনালীর নমনীয়তা বাড়ায়
দীর্ঘমেয়াদে BP নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
রক্তচাপ পরিমাপের গুরুত্ব
নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অভ্যাস। অনেক সময় আমরা শারীরিকভাবে ভালো বোধ করলেও রক্তচাপে অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই প্রতি কয়েক মাস অন্তর একবার রক্তচাপ পরিমাপ করা উচিত।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়
সঠিক জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্তচাপ সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
কিছু কার্যকর উপায় হলো:
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা
ফলমূল ও শাকসবজি বেশি খাওয়া
লবণ ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া
ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা
নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করা
যদি চিকিৎসক নির্দেশ দেন, তবে ওষুধ খেতে হবে নিয়ম মেনে।
রক্তচাপের ভারসাম্য নষ্ট হলে কী হয়?
রক্তচাপের ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীরের অনেক জটিলতা দেখা দেয়। রক্ত সঠিকভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পৌঁছাতে না পারলে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া, এমনকি মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতিও হতে পারে।
এই ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণ হতে পারে:
অতিরিক্ত মানসিক চাপ
পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া
শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি
ঘুমের অনিয়ম
অতিরিক্ত ধূমপান বা ক্যাফেইন গ্রহণ
তবে এর প্রতিকার নির্ভর করে মূল কারণের ওপর। এজন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই উত্তম।
রক্তচাপ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
শিশু ও বয়স্কদের রক্তচাপের মান এক নয়।
দিনের সময়ভেদে রক্তচাপের সামান্য পরিবর্তন স্বাভাবিক।
শীতল পরিবেশে রক্তনালী সংকুচিত হয়, ফলে রক্তচাপ কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।
ঘুম থেকে উঠেই রক্তচাপ সাধারণত তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
রক্তচাপ আমাদের জীবনের মৌলিক সূচক। এটি শুধু হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য নয়, বরং শরীরের প্রতিটি অঙ্গের কর্মক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই রক্তচাপকে অবহেলা না করে এর ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন থাকা জরুরি। সঠিক জীবনযাপন, মানসিক প্রশান্তি ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণই পারে রক্তচাপকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখতে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. রক্তচাপ কি সবসময় একরকম থাকে?
না, এটি সময়, খাদ্য, মানসিক চাপ ও শরীরের কার্যকলাপ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।
২. ঠান্ডা পানি পান করলে কি রক্তচাপের ওপর প্রভাব পড়ে?
অল্প পরিমাণে ঠান্ডা পানি শরীরকে সতেজ করে, তবে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি হঠাৎ রক্তনালীর সংকোচন ঘটিয়ে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে।
৩. রক্তচাপ কি রক্তের পরিমাণের সঙ্গে সম্পর্কিত?
হ্যাঁ, শরীরে রক্তের পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীতে চাপও কিছুটা বাড়ে, কম হলে চাপও কমে যেতে পারে।
৪. আবহাওয়ার পরিবর্তনে রক্তচাপের পরিবর্তন হয় কেন?
গরমে রক্তনালী প্রসারিত হয়, ফলে রক্তপ্রবাহ সহজ হয়। আবার ঠান্ডায় সংকুচিত হয়, এতে চাপ সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
৫. ঘন ঘন রক্তচাপ মাপা কি ক্ষতিকর?
না, বরং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করলে শরীরের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়, যা ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে।
৬. সকালে রক্তচাপ মাপা ভালো নাকি রাতে?
সাধারণত সকালে ঘুম থেকে ওঠার এক ঘণ্টা পর মাপলে ফলাফল নির্ভরযোগ্য হয়।
৭. ব্যায়ামের পর রক্তচাপ কেন কিছুটা বাড়ে?
কারণ তখন হৃদপিণ্ড দ্রুত রক্ত পাম্প করে শরীরের পেশীতে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়, যা সাময়িকভাবে চাপ বাড়ায়।
৮.শিশুদেরও কি রক্তচাপ সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, যদিও তা কম দেখা যায়। কিন্তু স্থূলতা, বংশগত কারণ বা কিডনি সমস্যা থাকলে শিশুরাও উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে
পারে।
৯. রক্তচাপ মাপার আগে চা বা খাবার খেলে কি ফলাফল বদলে যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, খাবার বা চা খাওয়ার পরপরই রক্তচাপ সাময়িকভাবে পরিবর্তিত হয়, ভুল ফলাফল আস্তে পারে, তাই মাপার আগে অন্তত ৩০ মিনিট বিরতি দেওয়া উচিত।
