প্লেগ রোগ: একটি ভয়ঙ্কর মহামারির ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
প্লেগ রোগ মানব ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতী মহামারি হিসেবে বিবেচিত। এই রোগের কারণে শত শত বছর আগে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। যদিও বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে এটি এখন তেমন ভয়ঙ্কর নয়, তবুও সময়মতো প্রতিকার না হলে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা প্লেগ রোগ কী, এর লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
প্লেগ রোগ কি ?
প্লেগ রোগ একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ যা মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আক্রমণ করে থাকে । এ মারাত্মক সংক্রামক রোগের কারণ হলো ব্যাকটেরিয়াম যা মাদার ব্যাকটেরিয়াম প্লেজমিডিয়া (Yersinia pestis) নামে পরিচিত। ব্যাকটেরিয়ামটি বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমে সংক্রমিত হয় ।
প্লেগ রোগ কত প্রকার ?
সাধারণত তিনটি ভিন্ন রূপে দেখা যায়:
বিউবনিক প্লেগ: এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরণ। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের লসিকা গ্রন্থি (lymph nodes) ফুলে যায় এবং প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এই গ্রন্থিগুলিকে "বিউবো" বলা হয়, যেখান থেকে নামকরণ করা হয়েছে বিউবনিক প্লেগ।
সেপটিসেমিক প্লেগ: এটি রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং দ্রুত মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এর লক্ষণ হলো উচ্চ জ্বর, রক্তক্ষরণ, অঙ্গ বিকল হওয়া ইত্যাদি।
নিউমোনিক প্লেগ: এটি ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। এটি সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায় এবং মারাত্মক ধরণ।
প্লেগ এর লক্ষণ গুলো কি কি ?
লক্ষণ: প্লেগের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। সবচেয়ে সাধারণ রূপ হল বিউবনিক প্লেগ, তারপরে সেপ্টিসেমিক ও নিউমোনিক প্লেগ। এছাড়া যে লক্ষণগুলো বিদ্যমান:-
প্লেগ রোগের লক্ষণগুলি তারপরও ভিন্ন হতে পারে, তবে ধারণকালে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা যেতে পারে:
কালো দাগ: একজন আক্রান্ত ব্যক্তির ফোড়া এবং এর উপর কালো দাগ দেখা যায়। দাগগুলি স্কারপ বা যোনিস্টের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।
লিম্ফ নোডের সুস্পষ্টতা: আক্রান্ত ব্যক্তির লিম্ফ নোড বিস্তারিত বৃদ্ধি পায় এবং তা ব্যাথা বা ব্যথার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
জ্বর: আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর হয় যা সাধারণত উচ্চ তাপমাত্রায় থাকে।
শ্বাসজনিত সমস্যা: শ্বাসজনিত আক্রান্ত প্রভৃতিতে শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসত্রাণ বা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা দেখা যায়।
প্লেগ এর কারণ কি ?
প্লেগ রোগের প্রধান কারণ হলো মাদার ব্যাকটেরিয়াম প্লেজমিডিয়া (Yersinia pestis) নামক ব্যাকটেরিয়ামের সংক্রমণ। এই ব্যাকটেরিয়ামটি হলো প্লেগের জীবাণুবিশিষ্ট কারক এবং এটি প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জন্তুগুলিতে বাস করতে পারে ।
প্লেগ ব্যাকটেরিয়াম মূলত প্রাণীদের মধ্যে একটি মাধ্যম হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যক্তির কাছে সংক্রমণ করে। সংক্রামিত কোন প্রাণী যেমন ইঁদুর বা মাছির কামড়ের দ্বারা মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী আক্রান্ত হতে পারে। সরাসরি স্পর্শেও এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। আর এতেই ব্যক্তির অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যক্তি গভীর অবস্থায় পড়ে এবং মারা যায় ।
প্লেগ রোগ নির্ণয়
রোগ নির্ণয়ে মানব চিকিৎসা ও প্রশাসনিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা দ্বারা করা হয়। রোগটি নির্ণয় করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করা হয়:
রোগের লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করা: এই রোগের সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তির উপর দেখা পাওয়া লক্ষণগুলি, যেমন প্রচন্ড দুর্বলতা, জ্বর, ঠান্ডা লাগা, প্রচন্ড পেটে ব্যথা, এবং কালো দাগ, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ইত্যাদি, পর্যবেক্ষণ করা হয়।
রোগের নির্দেশাবলী ও ইতিহাস সংগ্রহ করা: আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের ইতিহাস, কাছাকাছি রোগীদের সংখ্যা, মৃত্যুর হার ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
পরীক্ষামূলক পরীক্ষা: ব্যক্তির রক্ত, শ্বাসপ্রশ্বাসের নমুনা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে রোগের উপসর্গ জানা যায়।
প্লেগ এর চিকিৎসা কি ?
প্লেগ রোগের চিকিৎসা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিকিৎসা সাধারণত নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি শামিল করে:
ব্যক্তিগত সতর্কতা ও সাবধানতা: সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে, চিকিৎসার্থীদের প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো রোগীর সংস্পর্শের সাথে মিলিত হওয়া সংক্রান্ত ব্যতিবাচক কার্যক্রম পরিহার করা, যেমন সুপারিশকৃত রোগীদের সংস্পর্শে থাকতে হবে এবং সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ ঔষধ চিকিৎসা: এতে প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ ঔষধ সাধারণত এন্টিবায়োটিকস (যেমন স্ট্রেপ্টোমাইসিন বা টেট্রাসাইক্লিন) ব্যবহার করে চিকিৎসা করা হয়। অভ্যন্তরীণ ঔষধের ব্যবহারে আগে কর্তৃক ব্যক্তিগত পরীক্ষা এবং পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে।
প্লেগ এর প্রতিরোধ হিসেবে কি করা যেতে পারে ?
প্লেগ রোগের প্রতিরোধ জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
পরিচ্ছন্নতা: প্লেগ ব্যাকটেরিয়ামের সংক্রমণ থেকে বাচার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। নিয়মিতভাবে হাত ধুয়ে রাখা, নির্ভুল পানি পান এবং সাবান ব্যবহার করা উচিত।
হাইজিন মেইন্টেইনেন্স: প্রতিদিনের জীবনে কালো দাগের সম্পর্কে জানা এবং যত্ন অবলম্বন করা উচিত। আক্রান্ত প্রাণীর মধ্যে অবস্থান থেকে দূরে থাকা উচিত।
ভ্যাকসিনেশন: সহজ প্রতিরোধ হিসাবে ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তা জানা উচিত। ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়াটি কোনও নিদিষ্ট জনসংখ্যা বা প্রশাসনিক সম্প্রদায়ের জন্য পরামর্শপূর্বক হয়। তবে সেটা চিকিৎসক ঠিক করবেন কি করা উচিত।
সক্রিয় স্বাস্থ্যসেবা: সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পরিচর্যা করা যাতে অন্য কেউ আক্রান্ত না হয় ।
প্লেগ হলে মৃত্যু ঝুঁকি আছে কি?
হ্যাঁ, প্লেগ রোগ মানুষের জীবনের জন্য একটি মারাত্মক রোগ হতে পারে। প্লেগের একটি ধরণ হলো বাবন প্লেগ বা বাবন পিস্টুলি, যা একটি অত্যন্ত মারাত্মক প্রকোপের কারণ হতে পারে। যদিও সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শের সঙ্গে প্রভাবিত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন, তবে যদি সঠিক চিকিৎসা না দেওয়া হয় বা চিকিৎসা পাওয়া না যায়, তবে মারা যেতে পারেন।
প্লেগের মারাত্মক প্রভাব তাড়াতাড়ি দেখা দেওয়া যেতে পারে এবং অন্তত কিছু ঘন্টার মধ্যেই মারা যেতে পারেন। প্লেগে মারা যাওয়ার কারণ হতে পারে অন্যান্য মারাত্মক সংক্রমণ এবং মারাত্মক অবস্থার কম্পিউটেশন যেমন সেপ্টিকেমিয়া, অক্সিজেন সাপ্লাই সমস্যা ইত্যাদি।
প্লেগ রোগে সতর্কতা: কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ?
প্লেগ রোগ একটি ছোঁয়চে রোগ যা হামলা করে মানুষের মাঝে বিস্তারিত হতে পারে। তার বিস্তার এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
স্বাস্থ্যসেবা সরকারী/বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিন। কোন সন্দেহ থাকলে, সাম্প্রতিক কোনও মারাত্মক রোগ প্রতিষ্ঠানে চেকআপ এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সম্ভবত আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়া উচিত না। একজন থেকে অন্যকে ছড়িয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে যদি আপনার কাছে কেউ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়, তবে সংস্পর্শে আসা উচিত নয়।হাত ধৌত করতে সাবান ব্যবহার করুন।
জনসমাগমের এলাকায় থাকার থেকে সম্পর্ক সীমাবদ্ধ রাখুন। প্লেগ রোগ সাধারণত জনসমাগমের দিকে বিস্তারিত হয়। জনসমাগমে প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবা কেন্দ্র বা ভিন্ন বিন্যাসসহ কোনও স্থানে যাওয়ার আগে তার প্রকোপ বিষয়ে জানতে চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে এই ধরনের জনসমাগম থেকে বিরত থাকুন।
মৃত প্রাণী বা মাংস পণ্যের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। প্লেগ রোগ অক্সার্স হয়ে থাকতে পারে মৃত প্রাণী বা মাংস পণ্যে। প্রস্তুত খাবার এবং পালন করা খাদ্যের সন্ধানে যদি এই রোগের কোনও সংক্রমণের সন্দেহ থাকে, তবে এগুলি ব্যবহার এবং নির্মাণের থেকে দূরে থাকুন। এক কথায় বলা যেতে পারে যে প্লেগ থেকে সতর্ক থাকুন । বিপদ হতে পারে ।
প্লেগের ইতিহাস
প্লেগ রোগ মানবজাতির ইতিহাসে অনেকবার প্রাণঘাতী মহামারির আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ছিল:
ব্ল্যাক ডেথ (১৩৪৭-১৩৫১): ইউরোপে প্রায় ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায়।
গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডন (১৬৬৫): লন্ডনে প্রায় ১০০,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
ভারতে (১৮৯৬): মুম্বাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে।
আধুনিক যুগে প্লেগ
বর্তমানে এই রোগ খুব বেশি দেখা যায় না, তবে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলে মাঝে মাঝে এটির প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্লেগ প্রতিরোধে সচেতনতা, চিকিৎসা ও নজরদারির মাধ্যমে কাজ করছে।