গলগণ্ড রোগ, যাকে সাধারণ ভাষায় গলফুলা বলা হয়, এটি গলার সামনে থাইরয়েড গ্রন্থি অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়। এই রোগটি বিশ্বের অনেক অঞ্চলে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে আয়োডিন ঘাটতি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। এই প্রবন্ধে গলগণ্ড রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
গলগণ্ড বলতে কি বোঝায় ?
প্রচলিত অর্থের গলগন্ড বলতে থাইরয়েড গ্রন্থির যেকোনো ফোলাকে বোঝায়। অর্থাৎ থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই গলগণ্ড বা গয়টার বলা হয়। গলগন্ডের কিছু বিশেষ ধরনের চিকিৎসাবিজ্ঞানে গয়টার নামে ডাকা হয়, অর্থাৎ সব গলগন্ড গয়টার নয় । টিউমার, ক্যান্সার প্রদাহসহ নানা কারণে থাইরয়েড ফুলে যেতে পারে ।সেগুলো গয়টার নয়। আবার গয়টার থাইরয়েড গ্রন্থির কোন নির্দিষ্ট রোগ বোঝায় না, বরং থাইরয়েডের বিভিন্ন রোগের এক সাধারন বহিঃপ্রকাশকে বোঝায় । আচ্ছা তাহলে প্রশ্ন হল ' গলগণ্ড রোগ কেন হয় ? '
গলগণ্ড রোগের কোন লক্ষণ আছে কি ?
হ্যা আছে, গলগণ্ড এর লক্ষণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
স্থানসূচী: এটি সাধারণভাবে ছোট আকারের একটি দেখা যেতে পারে, যা কোনও সময়ে বৃদ্ধি করতে পারে।
সিরাবন্দি বা মোটা হওয়া: গলগণ্ড বৃদ্ধি হওয়া সাধারণ, এবং এটি মোটা হওয়ায় সমস্যার কারণ হতে পারে।
খাওয়া সমস্যা: গলগণ্ড কারণে খাওয়ায় সমস্যা হতে পারে, যার ফলে অক্সিজেন এবং খাদ্যে সমস্যা হতে পারে।
শ্বাস সমস্যা: গলগণ্ড হওয়ার আর একটা লক্ষণ হল শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া । এই সমস্যা অন্য কারণেও হলে হতে পারে । তবে গলগন্ডের একটা লক্ষণ ধরা হয় ।
মাথা ঘোরা: মাথা প্রায় অনেকেরই ঘুরে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয় । তবে এক্ষেত্রে মাথার উপর হাত বাড়ালে মাথা ঘোরে ।
কন্ঠস্বর কর্কশ: হঠাৎ করে যদি কন্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যায় সেটা গলগণ্ড রোগের লক্ষণ হতে পারে ।
অসুস্থতা বা শারীরিক দৌড়ানোর সময়ে দুর্বলতা: গলগণ্ড হওয়া সময়ে কিছু লোকে অসুস্থতা অথবা শারীরিক দৌড়ানোর সময়ে দুর্বলতা অনুভব করতে পারে।
গলার চাপ বা অস্বস্তি: গলগণ্ড রোগের অন্যতম একটি লক্ষণ হল গলায় চাপ লাগা । সেটা অনিচ্ছাকৃত অথবা নিজে থেকে হবে । আপনি নিজে চাপ দিচ্ছেন না।
যদি আপনি বা কারো কাছে এই ধরণের লক্ষণ দেখেন, তাদের একজন চিকিৎসকে দেখাতে বলা উচিত, যাতে উপযুক্ত চিকিৎসা ও যত্ন নেওয়া যায়।
গলগণ্ড রোগ কেন হয় ?
গলগণ্ড রোগের কিছু মৌলিক কারণ থাকতে পারে:
ভাইরাস ইনফেকশন: গলগণ্ড রোই কোনও ভাইরাসের আক্রমণ হতে পারে এবং এটি গলগণ্ডের উদ্দীপ্ত হতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন: কোন ব্যাকটেরিয়া একটি ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে, যা গলগণ্ড উদ্দীপ্ত করতে পারে।
অটোইমিউন রোগ:
হাশিমোটো’স থাইরয়েডাইটিস নামক একটি অটোইমিউন রোগে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজের থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে। এতে গ্রন্থির কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং হরমোন উৎপাদন কম হলে তা গলগণ্ড সৃষ্টি করতে পারে।
পুরানো বা অসুস্থ গলগণ্ড: কেউ যদি ইতিমধ্যে গলগণ্ডে সমস্যা থাকে, তার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থির গাঠ বা টিউমার:
থাইরয়েড গ্রন্থিতে কখনো কখনো গাঠ (nodule) তৈরি হতে পারে, যা একক বা বহু সংখ্যক হতে পারে। এগুলিও গলগণ্ড রোগের কারণ হতে পারে।
পানীয়: কিছু পানীয় দ্রব্য একটি গলগণ্ড বা তার চারপাশের জায়গায় প্রবাহিত হলে, এটি একটি গলগণ্ড উদ্দীপ্ত করতে সহায়ক হতে পারে।
হরমোনাল পরিবর্তন: কোনও হরমোনাল পরিবর্তনে একজন ব্যক্তির গলগণ্ডের বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, যেমন গর্ভাবস্থা,মেনোপজ ।
গলগণ্ডের জন্মজন্মান্তর সমস্যা: কিছু ব্যক্তিত্বে গলগণ্ডের সমস্যা হতে পারে যা জন্মজন্মান্তরের কারণে হয়ে থাকে। মনে জিনগত কারণ ।
ক্যান্সার: কিছু ক্যান্সার ধরনে গলগণ্ডে বৃদ্ধি হতে পারে, সেইসাথে যে লক্ষণগুলি সাধারণ গলগণ্ডের সমস্যার সাথে মিলে যাতে গুড়িতে চেয়ে তোলা যায় ।
অস্থায়ী বা স্থায়ী সংক্রামণ: কোনও সংক্রামণ গলগণ্ডে একটি বৃদ্ধি উদ্দীপ্ত করতে পারে, যা অস্থায়ী বা স্থায়ী হতে পারে।
কোষ্ঠকেন্দ্রের প্রবাহ বা কমপ্যাক্ট বৃদ্ধি: কোনও কোষ্ঠকেন্দ্রে একটি বৃদ্ধি হলে গলগণ্ডে উদ্দীপ্ত হতে পারে।
প্রদাহ: থাইরয়েডাইটিস এর কারণে গলগন্ড হতে পারে। যা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ।
আয়োডিনের অভাব: গলগণ্ডের অন্যতম একটি কারণ হল আয়োডিনের অভাব । গলগণ্ড রোগের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আইোডিন না থাকা। থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে আয়োডিন অপরিহার্য। যখন খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত আয়োডিন সরবরাহ না হয়, তখন থাইরয়েড গ্রন্থি আরও বেশি হরমোন তৈরি করতে চেষ্টা করে এবং এতে করে গ্রন্থিটি ফুলে যায়।
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি:
গলগণ্ড রোগ শনাক্ত করতে ডাক্তার নিম্নোক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন:
রক্ত পরীক্ষা: থাইরয়েড হরমোনের (T3, T4 এবং TSH) পরিমাণ পরিমাপ।
আল্ট্রাসাউন্ড: থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থা নির্ণয়ে।
ফাইন নিডল এসপিরেশন: যদি গ্রন্থিতে কোনো গাঠ থাকে, তাহলে তা পরীক্ষা করার জন্য।
আইসোটোপ স্ক্যান: থাইরয়েডের কার্যক্ষমতা নির্ণয়ে।
গলগণ্ড রোগ থেকে উত্তরণের উপায় কি ?
'গলগণ্ড রোগ কেন হয় ?'- এ তো জানা গেল এখন প্রশ্ন হলো এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কি ? উপায় নিম্নরূপ:
গলগণ্ডের উত্তরণের উপায় তার কারণের উপর নির্ভর করতে পারে। চিকিৎসক বা চিকিৎসা দানকারী দল আপনার অবস্থার মূল্যায়ন করতে পারে এবং উপযুক্ত চিকিৎসার পরিকল্পনা করতে পারে।
উত্তরণের উপায় বিষয়টি অধিকাংশই একটি বা একাধিক হতে পারে, যেমন:
ঔষধি চিকিৎসা: কিছু সময় বৃদ্ধি একটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে হতে পারে, এবং তাদের জন্য ঔষধি চিকিৎসা সহায়ক হতে পারে।
সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া: অবস্থাটি অনেকবার বৃদ্ধি সার্জিক্যাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা হয়, যাতে গলগন্ড সেরে যায়।
রেডিয়েশন থেরাপি: কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, রেডিয়েশন থেরাপি একটি বৃদ্ধির উত্তরণের উপায় হতে পারে।
হরমোন থেরাপি: হরমোন বা থাইরয়েড সমস্যা সম্পর্কিত ক্ষেত্রে, হরমোন থেরাপি একটি উপায় হতে পারে।
গলগণ্ড রোগ হলে কখন সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে ?
গলগণ্ডে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে যদি:
বৃদ্ধি মাত্রা অত্যধিক বা অত্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে: যদি গলগণ্ডের বৃদ্ধি অত্যন্ত বড় হয়ে থাকে এবং বাধাও তৈরি করে, তবে সার্জারির মাধ্যমে এটি সরানো হতে পারে।
গলগণ্ডে ক্যান্সার: যদি গলগণ্ডে ক্যান্সার রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং অবস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়,আর তখনই সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে ।
বৃদ্ধি অবস্থার কারণে সামগ্রিক সমস্যা: যদি বৃদ্ধি কারণে গলগণ্ডে সামগ্রিক সমস্যা উৎপন্ন হয়, যেমন শ্বাসকষ্ট বা খাওয়ানো সমস্যা, তাদের সমাধানের জন্য সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
বৃদ্ধির কারণে কমপ্যাক্ট কোষ্ঠকেন্দ্র: যদি গলগণ্ডের বৃদ্ধি একটি কোষ্ঠকেন্দ্রে প্রবাহিত হয় এবং কমপ্যাক্ট কোষ্ঠকেন্দ্র সৃষ্টি করে, তাদের মাধ্যমে সার্জারি করা হতে পারে।
গলগণ্ডের সার্জারি একটি গভীর এবং দারুণ প্রক্রিয়া হতে পারে এবং তার প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু এটি অনেক সময় গলগণ্ডের সমস্যা গুলির জন্য দ্রুত এবং কার্যকর সমাধান হতে পারে।
সার্জারির পর কি কি করা যাবে ? আর কি কি করা যাবে না ?
গলগণ্ডে সার্জারির পরে নিজের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে । যাতে করে
কী করা হবে:
চিকিৎসা পরীক্ষা: সার্জারির পর চিকিৎসক অথবা চিকিৎসা দানকারী দল পোষ্ট-অপারেটিভ প্রস্তুতির জন্য পোষ্ট-অপারেটিভ চিকিৎসা পরীক্ষা করতে পারে।
ঔষধ পরিসংখ্যান: নিজের যত্নের জন্য আপনি কোনও প্রয়োজনীয় ঔষধ নিতে পারেন।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: আপনার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত যত্ন নেওয়া হবে।
অস্থি ও স্নায়ু চেকআপ: পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে সার্জারির পরে অস্থি ও স্নায়ু ঠিকমতো যোগদান হয়েছে কি না।
খাদ্য ও পোষাক: স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং উপযোগী পোষাক পরিধান করতে হবে ।
কী করা যাবে না :
১. ঔষধ পরিত্যাগ: গলগণ্ড ভালো হয়ে গেছে মনে করে ঔষধ ছাড়া যাবে না । ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
আইোডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা
সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ
পর্যাপ্ত ফলমূল ও সবজি খাওয়া
গর্ভবতী ও শিশুদের জন্য বিশেষ যত্ন
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
গলগণ্ড রোগ একটি প্রতিরোধযোগ্য ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশে এখনো কিছু অঞ্চলে আয়োডিন ঘাটতির সমস্যা বিদ্যমান, তাই জনগণকে এই বিষয়ে আরও সচেতন করতে হবে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে গলগণ্ড রোগের জটিলতা এড়ানো যায় এবং একজন ব্যক্তি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।