এমপক্স ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় কি ?

 সন্ত বা পক্স কি তা কিন্তু আমরা সবাই জানি । যদি বলি জলবসন্ত, গুটিবসন্ত তাহলে অনায়াসে সবাই চিনে ফেলবে । এগুলো সবই ভাইরাস ঘটিত রোগ । এ সকল রোগ প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে খুব দেখা যেত । গ্রামের এক পাশে শুরু হলে অপর পাশে শেষ হয়ে পরবর্তী গ্রামে দেখা যেত ।

 

Mpox



আবার একাধারে কয়েকটি গ্রামে দেখা মিলত । মানুষের মৃত্যুর খবরও শোনা যেত । এক দিনে অনেকের মৃত্যুর খবর শোনা যেত । বর্তমানে বসন্ত হলেও মানুষের মৃত্যুর হার খুব কম । দেখা যায় না বললেই চলে । তবে ইদানিং একটি ভাইরাসের ছোঁয়া লেগেছে । আজকে সেটা নিয়েই আলোচনা করব । আর তা হল এমপক্স ভাইরাস । 


এমপক্স কি ? 


এমপক্স (Mpox), যা আগে মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল, একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা Monkeypox virus দ্বারা সৃষ্ট। এটি Orthopoxvirus প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত একটি ভাইরাস। এমপক্স সাধারণত পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়, তবে এটি মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমিত হতে পারে। তবে বাকি যে বসন্ত রোগ রয়েছে তার থেকে কম ক্ষতিকারক । 



এমপক্স এর প্রকারভেদ আছে কি ? 


হ্যাঁ ,আছে । আর তা হল : 

ক্লেড ১, যা সাধারণ ক্ষেত্রে গুরুতর হয়

 এবং ক্লেড ২।



এমপক্স এর লক্ষণ গুলো কি কি ? 


এমপক্সের লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৫ থেকে ২১ দিন পরে দেখা দেয় এবং এটি ২টি পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে থাকে: প্রাথমিক লক্ষণ এবং ত্বকের লক্ষণ।


১. প্রাথমিক লক্ষণ (Prodromal Phase):


এমপক্স সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত ১-৫ দিনের মধ্যে দেখা যায় এবং এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:


জ্বর: সাধারণত সংক্রমণের শুরুতে উচ্চ জ্বর হয়।


মাথাব্যথা: প্রচণ্ড মাথাব্যথা অনুভূত হতে পারে।


পেশি এবং পিঠে ব্যথা: পেশী এবং পিঠের ব্যথা হয়।


ক্লান্তি: শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, দুর্বলতা অনুভূত হয়।


লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া: গলার, কুঁচকির, বা বগলের লিম্ফ নোড ফুলে যায়, যা মাঙ্কিপক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।


২. ত্বকের লক্ষণ (Skin Eruption Phase):


প্রাথমিক লক্ষণগুলোর পর ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ত্বকের লক্ষণ দেখা দেয়, যা শরীরে ফুসকুড়ি বা গুটির আকারে প্রকাশ পায়:


ফুসকুড়ি (Rash): ফুসকুড়ি মুখে শুরু হয়ে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে হাতের তালু এবং পায়ের পাতা।


ম্যাকুলা (Macules): প্রথমে ফ্ল্যাট, লালচে দাগ হিসেবে দেখা দেয়।


প্যাপুলা (Papules): ম্যাকুলা গুলো সময়ের সাথে সাথে ফুলে ওঠে এবং হার্ড হয়ে যায়।


ভেসিকুলস (Vesicles): পরে, গুটির মধ্যে তরল জমা হয় এবং গুটি ফোস্কার মতো হয়ে যায়।


পুস্টুলস (Pustules): এরপর ভেসিকুলস গুলো পুস্টুলস এ পরিণত হয়, যেখানে গুটির মধ্যে পুঁজ জমা হয়।


স্ক্যাবস (Scabs): শেষ পর্যায়ে, পুস্টুলস গুলো শুকিয়ে স্ক্যাবস বা খোসা পড়া গুটি তৈরি করে যা পরে পড়ে যায়।


এছাড়া, গুটির সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে এবং এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাধারণত ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে ফুসকুড়ি শুকিয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।


এমপক্স এর কারণ সমুহ কি কি ? 



এমপক্সের (Mpox) প্রধান কারণ হলো Monkeypox virus, যা Orthopoxvirus প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাসটি পশু থেকে মানুষ এবং মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। এমপক্সের সংক্রমণের কারণসমূহ নিম্নরূপ:


১. পশু থেকে সংক্রমণ:


সংক্রমিত পশুর সংস্পর্শে আসা: প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে বসবাসকারী বন্য পশু যেমন বানর, ইঁদুর, গাম্ভা ইঁদুর, এবং অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী এই ভাইরাসের বাহক হতে পারে। সংক্রমিত পশুর কামড়, আঁচড়, বা তাদের রক্ত, শ্বাসযন্ত্রের কণা বা শরীরের অন্যান্য তরলের মাধ্যমে মানুষ সংক্রমিত হতে পারে।


সংক্রমিত পশুর মাংস বা পণ্য: সংক্রমিত পশুর মাংস (যদি তা ভালোভাবে রান্না না করা হয়) বা পশুর অন্যান্য পণ্য যেমন চামড়া, সংক্রমণ ঘটাতে পারে।


২. মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ:


ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শ: সংক্রমিত ব্যক্তির ত্বকের ফুসকুড়ি বা ক্ষত, শরীরের তরল (যেমন লালা, রক্ত), বা ত্বকের স্পর্শের মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে।


শ্বাসযন্ত্রের কণা: সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা কথা বলার সময় নির্গত শ্বাসযন্ত্রের ক্ষুদ্র কণা (ড্রপলেট) দীর্ঘ সময় ধরে কাছাকাছি অবস্থানে থাকলে অন্য ব্যক্তির মধ্যে এই রোগ ছড়াতে পারে।


দৈনন্দিন ব্যবহৃত বস্তু: সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে, এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামগ্রী স্পর্শ করলে এই রোগ ছড়াতে পারে।


৩. অন্যান্য কারণ:


সংক্রমিত অঞ্চলে ভ্রমণ: এমন অঞ্চলে ভ্রমণ যেখানে এমপক্সের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।


প্রতিরোধহীন যৌন সম্পর্ক: এমপক্স যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়াতে পারে, বিশেষ করে যাদের মধ্যে একাধিক যৌন সঙ্গী থাকে বা যারা ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে লিপ্ত থাকে।


এই কারণগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টিকা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।


এমপক্স ভাইরাস এর ক্ষেত্রে করণীয় কি ? 



এমপক্স (Mpox) সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত হলে এর থেকে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। এগুলো মূলত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, সঠিক চিকিৎসা, এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার ওপর নির্ভর করে।


১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:


সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে দূরত্ব বজায় রাখা: এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। বিশেষ করে, তাদের ফুসকুড়ি, ক্ষত বা শরীরের তরলের সংস্পর্শে না আসা।


ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (PPE) ব্যবহার: যদি কোনো কারণে সংক্রমিত ব্যক্তির যত্ন নিতে হয়, তাহলে মাস্ক, গ্লাভস, এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা উচিত।


স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা: নিয়মিত হাত ধোয়া, সাবান বা অ্যালকোহল ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা উচিত।


অসুস্থ বা মৃত পশুর সংস্পর্শ এড়ানো: এমন কোনো পশুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত যা অসুস্থ বা মারা গেছে এবং সন্দেহ করা হয় যে তারা এমপক্সের বাহক হতে পারে।


টিকা গ্রহণ: যারা এমপক্সের সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের টিকা নিতে উৎসাহিত করা উচিত।আবার যারা সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে রয়েছে এমন ব্যক্তি নিতে পারে । এমপক্সের জন্য বিশেষভাবে অনুমোদিত একটি টিকা রয়েছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে স্মলপক্সের টিকাও কার্যকর হতে পারে।


২. আক্রান্ত হলে করণীয়:


চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া: যদি এমপক্সের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী, চিকিৎসক উপসর্গ উপশমের জন্য ওষুধ ও পরামর্শ দেবেন।


আলাদা থাকা (Isolation): আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্যদের সংস্পর্শ থেকে আলাদা রাখা উচিত যতক্ষণ না ফুসকুড়ি শুকিয়ে যায় এবং সমস্ত খোসা পড়ে যায়।


আক্রান্ত স্থানের যত্ন: ত্বকের ফুসকুড়ি এবং ক্ষতগুলি পরিষ্কার এবং শুকনো রাখতে হবে। সংক্রমণ না বাড়ানোর জন্য এন্টিসেপ্টিক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে।


জলপান এবং বিশ্রাম: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রচুর জলপান করা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া উচিত।


ব্যবহৃত জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করা: আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পোশাক, চাদর, তোয়ালে এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী আলাদা করে পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে।


৩. সামাজিক ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দায়িত্ব:


অন্যান্যদের সচেতন করা: এমপক্স সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যেন কেউ ভুল তথ্যের কারণে আতঙ্কিত না হয় এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মানা: সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলা উচিত এবং প্রয়োজন হলে পরীক্ষা করানো উচিত।


এমপক্সে আক্রান্ত হলে বা এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে উপরের করণীয়গুলো মেনে চলা জরুরি, যাতে নিজেকে এবং অন্যদের এই রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়।


এমপক্স ভাইরাসে মৃত্যু ঝুঁকি আছে কি ? 


হ্যাঁ, এমপক্সে (Mpox) মৃত্যুর ঝুঁকি থাকতে পারে, তবে এটি সাধারণত রোগীর স্বাস্থ্য, বয়স, এবং সংক্রমণের ধরন ও তীব্রতার উপর নির্ভর করে। সাধারণত, বেশিরভাগ এমপক্স সংক্রমণ নিজে থেকেই সেরে যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী হয় না। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।


মৃত্যুর ঝুঁকির কারণসমূহ:


ভাইরাসের স্ট্রেন: এমপক্স ভাইরাসের দুটি প্রধান ক্লেড বা প্রজাতি আছে: কঙ্গো বেসিন ক্লেড এবং পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেড। কঙ্গো বেসিন ক্লেডের মৃত্যুর হার পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেডের তুলনায় বেশি, যা ১০% পর্যন্ত হতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেডে মৃত্যুর হার সাধারণত ১%-৩%।


স্বাস্থ্য পরিস্থিতি: যদি রোগীর পূর্ববর্তী কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা বা অন্যান্য গুরুতর রোগ (যেমন এইচআইভি/এইডস, ডায়াবেটিস), তাহলে এমপক্স সংক্রমণের ঝুঁকি এবং তীব্রতা বাড়তে পারে।


শিশু এবং বয়স্কদের জন্য ঝুঁকি: শিশুরা এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা সাধারণত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হতে পারে।


অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ও যত্ন: যদি সংক্রমণ সঠিক সময়ে শনাক্ত এবং চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে সংক্রমণ জটিল আকার ধারণ করতে পারে, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।


লক্ষণ ও জটিলতার কারণে মৃত্যু:


শ্বাসকষ্ট: যদি ফুসকুড়ি শ্বাসনালীর ভেতরে বা মুখের ভিতরে দেখা দেয়, তাহলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।


সেকেন্ডারি সংক্রমণ: ক্ষতগুলোতে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দেখা দিলে রোগটি আরও জটিল হতে পারে।


অঙ্গ বিকল: শরীরের প্রধান অঙ্গগুলো বিকল হতে পারে, যা গুরুতর জটিলতার কারণ হতে পারে।


মৃত্যুর হার:


মোটামুটি হিসাবে, এমপক্সের মৃত্যুর হার ১%-১০% এর মধ্যে হতে পারে, যা বেশিরভাগই ভাইরাসের ধরন, রোগীর স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে। তবে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সঠিক সময়ে সনাক্তকরণ ও চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।


সাধারণত, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং সঠিকভাবে পরিচালিত চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে অনেক দেশে মৃত্যুর হার কম থাকে। অতএব, যেকোনো সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম