এ যাবৎ কাল আমরা যত রোগের নাম শুনেছি তার মধ্যে গুলেন বারি সিনড্রোম নাম কি কেউ শুনেছি । হয়তো অনেকেই শুনেছি । আবার হয়তো অনেকেই না । আজকের এই লেখায় থাকছে এই গুলেন বারি সিনড্রোম সম্পর্কে । যা আপনাদের জানা জরুরী ।
গুলেনবারি সিনড্রোম (Guillain-Barre Syndrome) কি?
গুলেনবারি সিনড্রোম (Guillain-Barre Syndrome) বা GBS হল একটি বিরল কিন্তু গুরুতর অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্নায়ুর উপর আক্রমণ করে। এটি মূলত পেরিফেরাল নার্ভ বা স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে পেশি দুর্বলতা, অসাড়তা এবং কখনও কখনও পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) দেখা দিতে পারে। প্যারালাইসিস সম্পর্কে একটি লেখা এই ওয়েবসাইটে আছে চাইলে সেটি দেখতে পারেন ?
গুলেন বারি সিনড্রোম এর কারণ কি ?
গুলেন বারি সিনড্রোম এর কারণ :
গুলেনবারি সিনড্রোম সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের পর শরীরে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে Campylobacter jejuni নামক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের পর এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া ফ্লু, কোভিড-১৯, জিকা ভাইরাস বা অন্য যেকোনো সংক্রমণের পরও গুলেনবারি সিনড্রোম দেখা যেতে পারে ।
গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে মানুষের দুই তৃতীয়াংশই আগে ইনফেকশনে ভুগছিলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ছিল শ্বাসনালীর সংক্রমণ ।
Campylobacter jejuni নামক ব্যাকটেরিয়া গুলেন বারি সিনড্রোম এর জন্য ৩০% দায়ী ।
গুলেনবারি সিনড্রোমের লক্ষণসমূহ কি কি ?
গুলেনবারি সিনড্রোমের লক্ষণসমূহ:
গুলেনবারি সিনড্রোমের লক্ষণ সাধারণত নিম্নলিখিত পর্যায়ে দেখা যায়:
প্রাথমিক লক্ষণ:
হাত-পা বা শরীরের বিভিন্ন অংশে ঝিনঝিন বা অসাড় অনুভূতি
হালকা দুর্বলতা, যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ,দুই সপ্তাহে তীব্র হতে পারে ।
ঘাড়,পিঠ,কোমরে ব্যথা অনুভূত হতে পারে ।
উন্নত পর্যায়ের লক্ষণ:
পেশির শক্তি হ্রাস পাওয়া
হাঁটতে বা দাড়াতে কষ্ট হওয়া
হাত ও পায়ের নড়াচড়া সীমিত হয়ে যাওয়া
শ্বাসকষ্ট (কঠিন অবস্থায়)
গুরুতর অবস্থায়:
শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা
হার্টের রেট অনিয়মিত হওয়া
সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত (Paralysis)
গুলেনবারি সিনড্রোমের কত ধরণের হয় ?
গুলেনবারি সিনড্রোমের ধরণ:
গুলেনবারি সিনড্রোম কয়েকটি ধরণের হতে পারে, যার মধ্যে প্রধানতম হলো:
AIDP (Acute Inflammatory Demyelinating Polyneuropathy) – এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং ধীরে ধীরে পেশির দুর্বলতা বাড়ে।
AMAN (Acute Motor Axonal Neuropathy) – এটি প্রধানত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং পেশির দুর্বলতা তীব্র হতে পারে।
Miller Fisher Syndrome (MFS) – এটি চোখের পেশিগুলোর উপর বেশি প্রভাব ফেলে এবং ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।
গুলেনবারি সিনড্রোম নির্ণয় ও চিকিৎসা:
গুলেনবারি সিনড্রোম নির্ণয়ের জন্য সাধারণত নিচের পরীক্ষা করা হয়:
নিউরোলজিকাল পরীক্ষা
সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (CSF) পরীক্ষা
ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি (EMG)
গুলেনবারি সিনড্রোমের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক নেই, তবে নিচের চিকিৎসাগুলো করা হয়:
ইমিউনোগ্লোবুলিন থেরাপি (IVIG) – রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
প্লাজমা এক্সচেঞ্জ (Plasmapheresis) – রক্ত থেকে ক্ষতিকারক অ্যান্টিবডি বের করে ফেলা হয়।
ফিজিওথেরাপি – পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গুলেনবারি সিনড্রোমের পুনরুদ্ধার:
গুলেনবারি সিনড্রোম থেকে সুস্থ হতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। অধিকাংশ মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে কিছু ক্ষেত্রে পেশির দুর্বলতা বা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা থাকতে পারে।
গুলেন-বারি সিনড্রোম রোগীদের খাবারের তালিকা:
১. প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার (পেশি ও স্নায়ুর পুনর্গঠনে সহায়ক)
মাছ (সামুদ্রিক মাছ যেমন স্যামন, টুনা)
মুরগির মাংস (চর্বিবিহীন)
ডিম (বিশেষ করে সাদা অংশ)
ডাল (মসুর, ছোলা, মুগ)
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার (কম ফ্যাটযুক্ত দুধ, দই, পনির)
সয়া প্রোটিন (টোফু, সয়া দুধ)
২. ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার (স্নায়ুর পুনর্গঠনে সহায়ক)
শাকসবজি: পালং শাক, ব্রকলি, ক্যারট, বাঁধাকপি
ফল: কলা, আপেল, কমলা, বেরি জাতীয় ফল
ভিটামিন বি১২: ডিম, মাছ, দুগ্ধজাত খাবার
ভিটামিন ডি: সূর্যালোক, দুগ্ধজাত খাবার, ডিমের কুসুম
ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম: দুধ, বাদাম, কলা
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: সবুজ চা, ডার্ক চকলেট, বীজজাতীয় খাবার
৩. পর্যাপ্ত জলীয় ও হালকা খাবার (শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে ও হজমের জন্য সহায়ক)
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি (প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস)
ডাবের পানি (প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট)
লেবুর শরবত, গাজরের জুস
হালকা স্যুপ (মুরগির স্যুপ, সবজি স্যুপ) ,তবে বিক্রি হওয়া গুলো নয় ।
যা এড়ানো উচিত:
ভাজা-পোড়া ও অতিরিক্ত মশলাদার খাবার
চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (সফট ড্রিংকস, জাংক ফুড)
অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল
অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার
বিশেষ পরামর্শ:
✔ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের পরিকল্পনা করা উচিত।
✔ পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও হালকা ব্যায়াম করলে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।
✔ সঠিক পুষ্টি ও চিকিৎসার মাধ্যমে গুলেন-বারি সিনড্রোম থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুলেনবারি সিনড্রোম (Guillain-Barre Syndrome - GBS)
গুলেনবারি সিনড্রোম (GBS) বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে একটি বিরল কিন্তু গুরুতর স্নায়ুবিক রোগ হিসেবে পরিচিত। যদিও বাংলাদেশে এর বিস্তার নিয়ে পর্যাপ্ত পরিসংখ্যানিক গবেষণা কম রয়েছে, তবে এটি মাঝে মাঝে বিভিন্ন মেডিকেল রিপোর্ট ও হাসপাতালের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
বাংলাদেশে গুলেনবারি সিনড্রোমের কারণ ও ঝুঁকি
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে গুলেনবারি সিনড্রোম সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট সংক্রমণের পর দেখা দিতে পারে।
গুলেনবারি সিনড্রোমের লক্ষণগুলো অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও পাওয়া যায়, যেমন:
রোগ নির্ণয়ের জন্য সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (CSF) টেস্ট ও ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি (EMG) করার প্রয়োজন হয়, যা শুধুমাত্র বড় শহরগুলোর হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে গুলেনবারি সিনড্রোমের চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে গুলেনবারি সিনড্রোমের চিকিৎসায় কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
নির্ণয় ও সচেতনতার অভাব: গ্রামাঞ্চলে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা কম, ফলে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়।
চিকিৎসা ব্যয়: IVIG থেরাপি ও প্লাজমা এক্সচেঞ্জ চিকিৎসা ব্যয়বহুল, যা অনেক রোগীর পক্ষে বহন করা কঠিন।
পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞের অভাব: নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ এবং উন্নত চিকিৎসা সুবিধা শুধুমাত্র ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে সীমিত।
ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন: দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন ও ফিজিওথেরাপি সেবার অভাব অনেক রোগীর সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া ধীর করে।
বাংলাদেশে গুলেনবারি সিনড্রোম প্রতিরোধ ও করণীয়
যেহেতু গুলেনবারি সিনড্রোম পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য নয়, তাই কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করা যেতে পারে:
পরিষ্কার ও নিরাপদ খাবার গ্রহণ: Campylobacter jejuni সংক্রমণ রোধে বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া জরুরি।
ভাইরাল সংক্রমণ প্রতিরোধ: ডেঙ্গু ও অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শরীরে অসাড়তা বা দুর্বলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
হাসপাতালগুলোর নিউরোলজি বিভাগকে আরও উন্নত করা, যাতে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দ্রুত করা যায়।
উপসংহার
বাংলাদেশের মতো দেশে গুলেনবারি সিনড্রোম বিরল হলেও এটি মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়, উন্নত চিকিৎসা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সাধারণ মানুষকে এই রোগ সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুললে এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে গুলেনবারি সিনড্রোম মোকাবিলা করা সহজ হবে।