রাতকানা রোগ নামটি শুনেনি এমন কেউই নেই । যদি কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় । তবে সবার ক্ষেত্রে দেখা না গেলেও তারা কিন্তু ঠিকই এই রোগটিকে চিনেন । তবে এই রোগটি খুবই যন্ত্রণাদায়ক । যন্ত্রণাদায়ক এই জন্য বলছি যে এতে রোগী রাতের বেলায় দেখতে পান না । কিন্তু দিনের বেলায় ঠিকই দেখতে পান ।
রাতকানা রোগ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘নাইট ব্লাইন্ডনেস’ বা 'নাইকটালোপিয়া' বলা হয়, এটি এক ধরনের চোখের সমস্যা যার ফলে ব্যক্তি অন্ধকারে বা কম আলোতে স্পষ্ট দেখতে পারে না। এটি সাধারণত ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অপুষ্টি এবং সচেতনতার অভাবে এই রোগ একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
সাধারণত ২-৫ বছরের শিশুদের মধ্যে দেখা যায় । এতে সংবেদী 'রড়' কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় । স্বল্প আলোতে ভালো দেখা যায় না । চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখা যায় । রোগটা বেড়ে গেলে কর্নিয়া ঘোলাটে হয় । আর চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে গেলে অস্ত্রোপচার করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না ।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের উপায় অনেকে খুঁজে থাকেন । উপায় তো আছেই তবে সেটা জানানোর জন্য আজকের লেখা । তবে তার আগে জেনে আসি লক্ষণগুলো কি কি ?
রাতকানা রোগের লক্ষণগুলো কি কি ?
রাতকানা রোগের কিছু লক্ষণ হতে পারে:
সময়ের ভিত্তিতে বাসা থেকে বের হতে অসুবিধা: রাতে বাসা থেকে বের হতে বা সময় থেকে সময় ভিত্তিতে উঠতে অসুবিধা হতে পারে । এমন কি ড্রাইবিং করতে অসুবিধা হতে পারে ।
অস্বাভাবিক চাপ অনুভূত হতে পারে: ব্যক্তি প্রাকৃতিকভাবে গভীর ঘুম পেতে পারে না এবং অস্বাভাবিক চাপ অনুভূত করতে পারে।
স্বপ্নঘটনা হতে পারে: রাতে স্বপ্নঘটনা হতে পারে এবং ব্যক্তি নিজেকে ধরে রাখতে সময় নিতে পারে।
চোখে সমস্যা: রাতকানা রোগ হলে চোখ শুকিয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে । আর সেই সাথে চোখের সাদা অংশের উজ্জ্বল ভাব কমে যেতে পারে ।
স্পট: রাতকানা রোগে চোখের ভিতর ছোট ছোট দাগ বা স্পট দেখা যেতে পারে । তা ছাই রঙের দেখতে ।
এখন জানাব কোন কোন কারণে এই রোগের উদ্ভব ।
রাতকানা রোগের কেন হয় ?
কারণ নিচে উল্লেখ করা হল :
১. ভিটামিনের অভাব: প্রথমেই বলব যে কারণে রাতকানা রোগ দেখা দেয়, আর তা হচ্ছে ভিটামিন-এ এর অভাব । এটা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্য প্রযোজ্য । তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ওজন কম হওয়া ,পুষ্টির অভাব হলে দেখা যেতে পারে ।
২. বিভিন্ন রোগ : বিভিন্ন রোগ বলতে ডায়রিয়া,হাম, নিউমোনিয়া, ছাড়া এমন কিছু রোগ আছে যার কারণে রাতকানা রোগ দেখা যেতে পারে । কেননা এসব ক্ষেতে রোগীর দেহে ভিটামিন-এ এর ঘাটতি দেখা যায় । ফলে রাতকানা রোগ দেখা দিতে পারে।
৩. ঔষধের প্রতিক্রিয়া: ঔষধের প্রতিক্রিয়ায়ও রাতকানা রোগের মত সমস্যা হতে পারে । এই যেমন ধরুন ফেনোথায়াজিন ।
৪. বংশগত : বংশের কারো থাকলে আগত সন্তানের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । কম -বেশি হিসেবের ব্যাপার ।
৫. ছানি পড়া: রাতকানা রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে চোখে ছানি পড়া ।
৬. জিংকের অভাব : রাতকানা রোগ হতে পারে আর একটি উপাদানের অভাবে । আর সেটি হল জিংক । এটা কোন জিংক নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পারছেন।
রাতকানা রোগ প্রতিরোধের উপায় কি ?
রাতকানা রোগ প্রতিরোধের উপায় : নাইট ফল সিনড্রোম থেকে মুক্তি পেতে এবং সুস্থ নিদ্রা অর্জন করতে কিছু উপায় রয়েছে:
নিদ্রার সময়কাল বজায় রাখুন: প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে শোয়ার জন্য স্থান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ:
রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। ভিটামিন ‘এ’ চোখের রেটিনাকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে এবং রাতের অন্ধকারে দেখার ক্ষমতা বজায় রাখে।
ভিটামিন ‘এ’-এর উৎস:
গাজর
মিষ্টি কুমড়া
পালং শাক ও অন্যান্য শাকসবজি
কলিজা (গরু/মুরগির)
ডিমের কুসুম
বড়দের জন্য: এই রোগ প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন এ রয়েছে এমন সব খাবার খেতে হবে যা উপরে বলা আছে , মলা-ঢেলা মাছ খাওয়া উচিত। ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেতে হবে ।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য
আম, পেঁপে ও অন্যান্য হলুদ-কমলা রঙের ফল
বাচ্চার যত্ন: জন্মের পর প্রথম ৫-৬ মাস বুকের দুধ খাওয়ানো বাধ্যতামূলক । অন্তত ২ বছর খাওয়াতে হবে । পাশাপাশি ভিটামিন -এ পাওয়া যায় এমন সব খাবার খাওয়ানো । ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে প্রতি বছর ৬ মাস ও ১ বছরের ব্যবধানে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচি পরিচালনা করে। এই কর্মসূচি শিশুর দৃষ্টিশক্তি সুরক্ষা ও এই রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
মাতাপিতার করণীয়:
শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা । স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী বা কমিউনিটি ক্লিনিকের সাথে যোগাযোগ রাখা
পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতকরণ:
পরিবারে সবার জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, শিশু ও কিশোরীদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা জরুরি। একটি সুস্থ শরীর ও চোখের দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখতে সুষম খাদ্যাভ্যাস অপরিহার্য।
সুষম খাদ্য বলতে বোঝায়:
প্রোটিন: মাছ, ডাল, ডিম
শর্করা: ভাত, রুটি
চর্বি: তেল, ঘি
ভিটামিন ও খনিজ: শাকসবজি ও ফলমূল
ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন: শোকর সময়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকা উপকারী হতে পারে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
রাতকানা রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। গ্রামে ও শহরে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ভিটামিন ‘এ’-এর গুরুত্ব বোঝানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত।
রাতকানা রোগ হলে করণীয় কি ?
করণীয়:
স্কুলে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান
মা-সমাবেশ ও গ্রামীণ সভার মাধ্যমে সচেতনতা কর্মসূচি
রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা:
যদি কোন শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অন্ধকারে ভালো দেখতে না পারে, তাহলে দ্রুত চোখের ডাক্তার বা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া উচিত। সময়মতো চিকিৎসা না হলে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
চিকিৎসার উপায়:
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ
চোখের অন্যান্য সমস্যা থাকলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ
উপরের এই উপায়গুলো প্রয়োজনে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজেই নিজে কিছু করতে যাবেন না । নিজে নিজে কিছু করার নেহায়েৎ বোকামি ছাড়া কিছুই না ।
নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ:
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করাও রাতকানা প্রতিরোধে সাহায্য করে। সংক্রমণ এবং অন্যান্য রোগ শরীরে ভিটামিন শোষণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতির ঝুঁকি বাড়ায়।
উদ্যোগসমূহ:
বিশুদ্ধ পানি পান
হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা
মলমূত্র নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা
শিশুকে ডায়রিয়া হলে দ্রুত ওআরএস ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো
সবশেষে যা বলব তা হল রাতকানা একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এটি প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল গ্রহণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে প্রতিরোধ করতে পারলে শুধু দৃষ্টিশক্তি নয়, একজন শিশুর ভবিষ্যৎও নিরাপদ রাখা সম্ভব। তাই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সকলকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।